Breaking News

পবিত্র শব-ই-বরাতের সর্ম্পকে নিজে জানুন, অন্যকে জানান.....(৩)

আগামী ১৭ তারিখ রবিবার পবিত্র শব-ই বরাত, সেই উপলক্ষ্যে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো.......

শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত তথা হাদীসের পরিভাষায় নিসফে শাবানের রাতকে আমাদের দেশে শবে বরাত বলা হয়ে থাকে। শব শব্দটি ফার্সী এর অর্থ রাত এবং বরাত শব্দটি ফার্সী ও আরবী উভয় ভাষাতেই এর ব্যবহার রয়েছে। ফার্সী ভাষায় বরাত শব্দটির অর্থ হচ্ছে ভাগ্য। এদিক থেকে ফার্সী ভাষায় শবে বরাত অর্থ ভাগ্য রজনী বা ভাগ্যের রাত। অপরদিকে বরাত শব্দটিকে যদি আরবী শব্দ বারাআতুন থেকে উদ্ভূত ধরা যায় তবে-এর অর্থ দাঁড়ায় নিষ্কৃতি দায়মুক্তি, অব্যাহতি ইত্যাদি। এর পূর্বে শব’ শব্দটি যুক্ত করলে ‘শবে বারা’আত’-এর অর্থ দাঁড়ায় নিষ্কৃতি, দায়মুক্তি, অব্যাহতি ইত্যাদি রাত। শবেবরাত পরিভাষাটি যেহেতু ফার্সী শব্দ শব দিয়ে শুরু করা হয়েছে সেহেতু এটি নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যায় যে, শবেবরাত উদযাপন প্রথাটি মাহবাতেওহী তথা ওহী নাযিলের দেশ আরব দেশ হতে আসেনি, বরং এসেছে মূলত: ইরান ও ইরানীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি হতে এবং এরই প্রভাবে এই পর্বটি মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে পার্শ্ববর্তী আমাদের এই উপমহাদেশ সহ আশেপাশের দেশসমূহে এমনকি ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে রাতটি খুবই জাঁকজমকের সাথে পালন করা হয়ে থাকে। অবশ্য আরব দেশে যে রাতটি একেবারেই উদযাপন করা হয় না, তা বলা যায় না। ইরানের পার্শ্ববর্তী ইরাকের কিছু কিছু অংশসহ কোন কোন আরবীয় এলাকায়ও নিসফে শাবান তথা শাবানের অর্ধেকের রাতের ফযিলত গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাতটি বিভিন্ন নফল ইবাদত করার মাধ্যমে পালন করা হয়ে থাকে। কেননা এই রাতটি নাম করণে যত বিভ্রাটই থাকুক না কেন হাদীসের ভাষায় নিসফে শাবান তথা শাবান মাসের অর্ধ রাতের গুরুত্ব রয়েছে। হযরত আলী (রা:) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন যখন অর্ধশাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে ইবাদত কর এবং পরের দিনটিতে রোযা রাখ। কেননা প্রত্যেক রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কোন ক্ষমা প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোন রিযিক প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে রিযিক দান করব। কোন বিপদগ্রস্থ আছে কি? আমি তাকে বিপদমুক্ত করব। আর সুবহে সাদেক পর্যন্ত এ ডাক অব্যাহত থাকে (ইবনে মাজাহ) এছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরো কিছু দুর্বল হাদীস রয়েছে যে গুলো দুর্বল হলেও ফযীলতের হাদীস হিসাবে অনেকে আমল করে থাকেন। যেমন- হযরত আয়েশা (রা:)-এর ভাষায় কোন এক শাবান মাসের অর্ধ রাতে নবী করীম (স.) কে বিছানায় পাওয়া যাচ্ছিল না। খুঁজে দেখা গেল তিনি মদীনার বাকীউল গারকাদ বা জান্নাতুল বাকীতে কবর যিয়ারত করছেন (মুসলিম) এই হাদীসের ভিত্তিতে এ রাতে নফল আমল হিসাবে অনেকেই মৃত আত্মীয়-স্বজনের কবর যিয়ারত করে থাকেন।

শবে বরাতের অস্তিত্ব প্রমাণ করার ক্ষেত্রে কেউ কেউ সুরায়ে দুখানের প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াতের উদ্ধৃতি দেন। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (আল কুরআন; ৪৪: ২-৪) অধিকাংশ তাফসীর বিশেষজ্ঞের মতে এখানে বরকতময় রাত বলে শবে কদর বুঝানো হয়েছে যা রমযান মাসের শেষ দশকে হয়ে থাকে এবং কুরআন নাযিল হওয়ার কারণেই এরাত বরকতপূর্ণ হয়েছে। কুরআন নাযিলের রাত বলে যেখানে সুরাতুল কদর নামে একটি সুরা রয়েছে তাছাড়া রমযান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে বলে সুরায়ে বাকারায়ে উল্লেখ রয়েছে সেখানে শুধু মাত্র হযরত ইকরামার একটি রেওয়ায়াতের বরাতে লাইলাতুন মুবারাকা কে বরাতের রাত বলা ঠিক হবে না। বরং এটাও ক্বদরের রাত। তাছাড়া এ রাতে প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত এটাও ক্বদরের রাতেই হয়ে থাকে কেননা ক্বদরের এক অর্থ তাকদীর বা ভাগ্য। যা ক্বদরের রাতে হয়ে থাকে বলে এ রাতকে লাইলাতুল ক্বদর বলা হয়ে থাকে। (কুরতুবী)

প্রকৃতপক্ষে রমযান মাসের প্রস্তুতি গ্রহণের মাস হিসাবে শাবান মাস একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাস। কেননা নবী করীম (স.) শাবান মাসে এ দোআটি বেশি বেশি করতেন, ‘হে আল্লাহ রজব ও শাবান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমযান পর্যন্ত আমাদেরকে পৌঁছার তওফীক দিন। ‘রমযানের প্রস্তুতি হিসাবে নবী করীম এ মাসে বেশি বেশি করে নিজেও রোযা রাখতেন এবং সাহাবীদেরকেও রোযা পালন করতে বলতেন। হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত নবী করীম (স.) শাবান মাসের চেয়ে বেশি আর কোন মাসে রোযা রাখতেন না। বলতে গেলে প্রায় পুরো শাবান মাসই রোযা রাখতেন। অন্য রাওয়ায়াতে বলা হয়েছে তিনি শাবান মাসে স্বল্পসংখ্যক রোযা রাখতেন (বুখারী ও মুসলিম)। রমযান মাসের প্রস্তুতি হিসাবে শাবান মাসের অন্যতম নফল ইবাদত রোযা পালন হিসাবে নিসফে শাবান তথা বরাতের আগে মিলিয়ে কমপক্ষে দুটো রোযা পালন করা উচিৎ। তাছাড়া প্রতিচন্দ্র মাসের তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখে ‘আইয়াম বীযের’ তিনটি নফল রোযা পালন করার উপর নবী করীম (স.) অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। হযরত আবুযর (রা:) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যখন তুমি মাসে তিনটি রোযা রাখতে চাও, তখন তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখে রোযা রাখ। (তিরমিযি) হযরত কাতাদাহ ইবনে ম্পিহান (রা.) হতে বর্ণিত নবী করীম (স.) আমাদেরকে আইয়ামে বীযের রোযা রাখার হুকুম দিতেন আর আইয়ামে বীযের দিনগুলো হচ্ছে মাসের তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখ। (আবু দাউদ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ গৃহে অবস্থানকালে অথবা সফররত অবস্থায় কখনও আইয়ামে বীযের রোযা ছাড়তেন না (নামাঈ)। এমতাবস্থায় কেউ যদি নিসফে শাবান বা বরাতের রাত পালন উপলক্ষে শাবান মাসের তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখের তিনটি নফল রোযা রাখে তবে সে এই সুবাদে আইয়ামে বীযের নফল রোযার সওয়াবও পেয়ে যায়। নিসফে শাবানের রাতে নফল নামায আদায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। কিন্তু এ সমস্ত আমলের ক্ষেত্রে আবেগ তাড়িত হয়ে কোনরকম বাড়াবাড়ি করা যাবে না এবং এ সমস্ত নফল এবাদতকে ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুসাককাদাহর উপর গুরুত্ব দেয়া যাবে না। অথবা নফল আদায় করতে গিয়ে কোন ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুআক্কাদায়হ আদায় যেন বিঘিœত না হয় সেদিকে তীক্ষœ নজর রাখতে হবে। রাত জেগে নফল নামায আদায় মসজিদের ও নিজ গৃহে নিরবে নিভৃতে আদায় করা যেতে পারে। কেননা, ইসলামী শরীয়তের মতে মসজিদে পাঁচ ওয়াকত ফরয নামায জামায়াতের সাথে আদায় করতে হবে আর বাকী সুন্নাত ও নফল নামাজ ঘরে আদায় করাই উত্তম। কেননা তাতে ঘরেও একটি নামাজী পরিবেশ তৈরি হয়। হযরত যায়েদ ইবনে সাবিদ (রা.) হতে বর্ণিত নবী করিম (স.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের ঘরে নামাজ পড়। কারণ ফরয নামাজসমূহ ছাড়া মানুষের নামাজের মধ্যে সেই নামাজই উত্তম যা তার ঘরে আদায় করে। (বুখারী ও মুসলিম) কিন্তু বরাতের রাতে লক্ষ্য করা যায় কিছু লোক টুপি পাঞ্জাবী পরে সারা রাত এ মসজিদ হতে সে মসজিদ, এ মাজার হতে সে মাজার অথবা রাস্তায় রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করা সঙ্গত নয়।

এরাতের আরেকটি আমল আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কবর জিয়ারত। দুর্বল হাদীস দ্বারা এটি প্রমাণিত হলেও ইসলামী শরীয়ত যেহেতু ‘কবর জিয়ারত দ্বারা জিয়ারতকারীর উপকার হয়। কবর দেখে সে আখেরাতমুখী হওয়ার সুযোগ পায় একারণে কবর জিয়ারত বৈধ করেছে সুতরাং শরীয়তের বিধান পালন করে, এরাতেও আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর কবর জিয়ারত করা যেতে পারে। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, ‘হযরত বুরাইদা (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স.) বলেছেন, ‘আমি ইতিপূর্বে তোমাদেরকে কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা কবর জিয়ারত কর। অন্য রিওয়ায়াতে আছে, এটা পরকালকে স্মরণ করিয়ে দেয়। (মুসলিম)। “হযরত বুরাইদা (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করীম (স.) কবর জিয়ারতে গিয়ে একথা বলতে শিক্ষা দিতেন, ‘হে কবরবাসী মুমিন ও মুসলিমগণ! তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমরাও ইন্শাল্লাহ্ তোমাদের সাথে মিলিত হবো। আমরা আল্লাহ্র নিকট আমাদের এবং তোমাদের জন্য ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।” (মুসলিম)

শবেবরাত পালনে আরেকটি প্রথা প্রচলিত আছে, তা হচ্ছে- এ রাতে আতশবাজী ও হালুয়া রুটি বিতরণ। ইসলামী শরীয়ত আতশবাজীর বৈধতা দেয় না। আর হালুয়া রুটি বিতরণের মাধ্যমে মেহমানদারী বা অন্নহীনদের অন্নদান হলেও খাস করে এই রাতে হালুয়া রুটির ছড়াছড়ি করার অনুমতি দেয় না বরং সারা বছরই হালুয়া-রুটি বন্টন করা যায়।